
মুহুর্ত অনলাইন: ২০০৯ সাল, মানুষ ভোট দিয়েছিল উন্নয়নের জন্য, ভেবেছিল গণতন্ত্র ফিরবে, খোলা আকাশের নিচে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়া যাবে, কিন্তু সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হলো খুব তাড়াতাড়ি, ক্ষমতার মঞ্চে একে একে ঝরতে শুরু করল প্রাণ, ঘুম, খুন, বন্দুক যুদ্ধ, বিচারহীনতা সব, মিলিয়ে হাসিনার ১৫ বছর ছিল ভয়ঙ্কর এক মৃত্যুযাত্রা, হাসিনার ১৫ বছরে দেশে ৬০,০০০ খুন, প্রতিবছর ৪০০০, প্রতি মাসে ৩০০ টি, আর প্রতিদিন ১১ টি হত্যাকাণ্ড, এই সংখ্যা শুধু সরকারি নথিভুক্ত হত্যাকাণ্ড, টার্গেট কিলিং, রাজনৈতিক সহিংসতা, অপহরণ, আর বন্দুক যুদ্ধ, সব মিলিয়ে পুরো দেশটাই হয়ে ওঠে এক অঘোষিত যুদ্ধক্ষেত্র।
২০১২ সালের হরতালে, দর্জি দোকানের কর্মচারী বিশ্বজিত দাস বের হয়েছিল কাজে, পুরান ঢাকার আদালতের সামনে, ছাত্রলীগের একটি দল তাকে ঘিরে ধরে, শিবির ট্যাগ দিয়ে রাস্তায় ফেলে কুপাতে শুরু করে, বিশ্বজিত চিৎকার করে বলেছিলেন, আমি হিন্দু, শিবির না, আমি শুধু কাজের জন্য বের হয়েছি, কিন্তু তার কথা কেউ শুনেনি, ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় একজন নির্দোষ তরুণকে, এই হত্যার ভিডিও ক্যামেরায় ধরা পড়ে, আটজনের ফাঁসির রায় হয়, ১৩ জনের যাবজ্জীবন, অপরাধীদের শাস্তি হয় তবে কাগজে, নথিতে, কিন্তু বাস্তবতা রায় কার্যকর হয়নি, অভিযুক্তরা বের হয়ে আবার রাজপথে।
সেই শুরু, তারপর একের পর এক নিখোঁজ হতে থাকেন বিরোধীদলীয় নেতারা, ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, তাদের খোঁজ আজও মেলেনি, পরিবারগুলো আজও দরজায় তাকিয়ে থাকে, আজ বুঝি ফিরে আসবে, কিন্তু কেউ ফিরে আসে না।
সাল ২০১৪, নারায়ণগঞ্জে র্যাব তুলে নেয় সাতজনকে, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো জেলায়, ততক্ষণে খালি রাস্তাঘাট, সবাই ভীত সন্ত্রস্ত, একে একে গড়ালো তিন দিন, তাদের লাশ ভেসে ওঠে নদীতে, খবরটি ছড়িয়ে পড়তেই কেঁপে উঠেছিল পুরো দেশ, গ্রেফতার হয় আওয়ামী লীগের নেতা নূর হোসেন, যদিও নেপথ্যে ছিল আরো বড় নাম, শামীম উসমান, বিচার থেমে গেল কেউ দুঃস্বকার করলো না, রাষ্ট্র বলল তদন্ত চলছে, কিন্তু এটি এমন তদন্ত যার কোন গন্তব্য নেই।
২০১৯ সালে, বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ, দেশবিরোধী চুক্তির বিরুদ্ধে কথা বলেছিল ফেসবুকে, তারই জেড় ধরে, ৬ই অক্টোবর রাত আটটায় আবরারকে শেরে বাংলা হলের ২০১১ নম্বর রুমে ডেকে নেয় ছাত্রলীগ, শুরু হয় জেরা, রাত গভীর হলো, সবাই যখন ঘুমিয়ে আচ্ছন্ন, তখন ক্রিকেট স্ট্যাম্প, হকি স্টিক দিয়ে শুরু হয় নির্মম নির্যাতন, রুমমেটরা কান্না করছিল, তবু মার বন্ধ হয়নি, ততক্ষণে আবরার আর নেই, মামলা হলো দোষীদের বিরুদ্ধে, রায় হয় মৃত্যুদন্ডের, কিন্তু পাঁচ বছর কেটে গেলেও সেই রায় আজও কার্যকর হয়নি, মৃত্যুর আগে আবরার লিখে গিয়েছিল, আমার দোষ একটাই, আমি দেশকে ভালোবাসি।
আরো আছে, ২০১৬ সালে খুন হয় আওয়ামী লীগের নেতা এমপি লিটন, ঘরে ঢুকে গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে, খুন জড়িত ছিল জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি, সাত জনের ফাঁসির রায় হয়, তাদের একজনের মৃত্যু হয় জেলেই, বাকি সবাই এখনো অপেক্ষায় না জানি কবে বিচার হবে।
এরপর একে একে খুন হতে থাকেন আওয়ামী লীগের নেতারাও, মিল্কি, টিপু, লোকমান, সবাই এই দলেরই, শুরু হয় দলের ভেতরেই রক্তের খেলা, তাদের ভেতরেই ছিল শিকার, তাদের ভেতরেই ছিল শিকারি, এজন্য ক্ষমতার টানা, পূরণে গড়া এক রক্তাক্ত নাটক আর ক্রসফায়ার, সে তো দেশের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নাটক, গুলি খেয়ে পালাতে গিয়ে পড়ে যায়, পরে মারা যায়, এই কল্পিত গল্পের অতল গভীরে হারিয়ে গিয়েছে ১৯২৬ টি তাজা প্রাণ, কেউ বিচার চায়নি, কেউ বিচার পায়নি, তাদের পরিবাররা শুধু রাতে দরজা বন্ধ করে কাঁদে, সকালে উঠে না, কারণ ঘুম আসে না, আর পুলিশের ওয়েবসাইট থেকে অপরাধের পরিসংখ্যান সরিয়ে ফেলা হয়, প্রকাশিত তথ্য লুকানো হয়, তথ্য মানে সত্য, আর সত্য মানে সরকারের মুখোশ খুলে যাওয়া, তাই পরিসংখ্যানই গায়েব করে দেয়া হয়।
২০১৯ থেকে ২০২৪, এই ছয় বছরে খুন হয়েছে প্রায় ২০,০০০ মানুষ, সবচেয়ে বেশি খুন ঢাকা আর চট্টগ্রাম বিভাগে, এই শহরগুলো যেন খুনের হাট, একটা সময় ছিল যখন মানুষ ভোরবেলা রাস্তায় বের হতো, কিন্তু কেউ কেউ আর ফেরত আসতো না, একটা সময় ছিল যখন রাজনৈতিক কর্মসূচি মানে হরতাল নয়, ঘুম, খুন আর চোখের পানি।
তথ্য বলছে গত ১৫ বছরে ৫৯৮২৩ টি হত্যা মামলা হয়েছে, চার্জশিট দেওয়া হয়েছে প্রায় ১৮ লাখ মামলায়, তার মধ্যে রায় হয়েছে মাত্র ২ লাখ ১০০০ মামলায়, বাকিগুলো বিচারের আশ্বাসে বিচারহীনতায় চাপা পড়েছে ফাইলের নিচে, প্রশ্ন হচ্ছে এই দেশ কি স্বাধীন হয়েছিল এজন্য? এই গণতন্ত্র কি এমনই ছিল যেখানে ভিন্নমত মানেই ঘুম আর প্রতিবাদ মানেই মৃত্যু?
২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট, ছাত্রজনতার অভ্যত্থানে পতন হয় এক শাসকের, একটি ভয়ঙ্কর অধ্যায় শেষ হয়, কিন্তু রেখে যায় হাজার হাজার খালি কবর, আধা শেষ মামলার ফাইল আর প্রশ্নে ভরা একটি ইতিহাস।
শেয়ার করুন
- Click to share on Facebook (Opens in new window) Facebook
- Click to print (Opens in new window) Print
- Click to share on WhatsApp (Opens in new window) WhatsApp
- Click to email a link to a friend (Opens in new window) Email
- Click to share on LinkedIn (Opens in new window) LinkedIn
- Click to share on X (Opens in new window) X
- Click to share on X (Opens in new window) X