
চৌধুরী মাশকুর সালাম:
আমি মেজর ডালিম বলছি, অদ্য সকাল হইতে খন্দকার মোস্তাক আহমেদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করিয়াছে, শেখ মুজিব ও তার খুনি দুর্নিতিবাজ সরকারকে উৎখাত করা হইয়াছে, এখন হতে সারাদেশে সামরিক আইন জারি করা হলো, আপনারা সবাই আমাদের সাথে সহযোগিতা করুন। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, কোন অসুবিধা আপনাদের হইবে না। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট ইথারে ভেসে আসা এই বজ্রধ্বনির ঘোষণা শুনেছিল দেশবাসী, প্রবল প্রতাপশালী শেখ মুজিবের শাসনের অবসান হয়েছে। সারাদেশে কারফিউ জারী, কিন্তু কি অবাক ব্যাপার কারফিউ ভেঙ্গে দলে দলে উৎফুল্ল জনতা নেমে আসছে রাস্তায়। চারিদিকে মুক্তির আনন্দ, এক বড় স্বৈরাচারের পতন হয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ইতিহাসে এমন এক দিন, যা বাংলাদেশের রাজনীতি পরিবর্তনের সাক্ষী। দেশের শাসনব্যবস্থা, রাজনীতি ও সামাজিক কাঠামোতে এদিন ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছে যে তা আজও আমাদের চিন্তা-ভাবনার কেন্দ্রে রয়েছে।
সেদিন ভোরে বাংলাদেশ বেতারে ঘোষিত হয়, “আমি মেজর ডালিম বলছি… খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সরকারকে উৎখাত করেছে।” এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই সারা দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়। এরপর শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যরা একটি সেনা অভ্যুত্থানে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হন, এটি ছিল একটি বিপ্লব।
বিপ্লবের সংজ্ঞা, উদ্দেশ্য, এবং নৈতিকতার বিশ্লেষণে উঠে আসে কিছু মৌলিক প্রশ্ন। বিপ্লবীরা সাধারণত শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বৃহত্তর রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিবর্তন আনার জন্য।
এক্ষেত্রে একটি তত্ত্ব হলো, বিপ্লবী ও সৈনিকদের কর্মকাণ্ডকে কখনোই সাধারণ অপরাধের চোখে দেখা যায় না। তারা যদি রাষ্ট্র বা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করেন, তবে তা ন্যায্যতার পর্যায়ে পড়ে। ফরাসি এবং রুশ বিপ্লবের মতো ঐতিহাসিক উদাহরণগুলোতেও আমরা দেখি, বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড অনেক সময় অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং রক্তক্ষয়ী হলেও সমাজে পরিবর্তনের জন্য তা স্বীকৃত হয়েছে।
১৫ আগস্টের ঘটনার পর একটি গুরুতর অভিযোগ হলো, মুজিব পরিবারে শিশু সদস্যরাও নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। তবে এ বিষয়ে বিতর্ক থেকে যায়। এ ঘটনার সাথে ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের সময় লুই শার্লস বা রুশ বিপ্লবের সময় জারের পরিবারের শিশু সদস্যদের হত্যা তুলনামূলকভাবে সামনে আনা হয়।
এই ঐতিহাসিক উদাহরণে দেখা যায়, বিপ্লবকালে কিছু শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ১৫ আগস্টে এটি “কোল্যাটারাল ড্যামেজ” বা অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা ছিল মাত্র বলে মনে করা হয়।
মেজর ডালিম ছিলেন ১৯৭৫-এর সামরিক অভ্যুত্থানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ তাকে বিপ্লবী নায়ক হিসেবে দেখেন। মেজর ডালিম সম্পর্কে বলা যায়, তিনি একটি “ন্যায়সঙ্গত অভ্যুত্থান” ঘটিয়েছিলেন। কিছু সমালোচকরা মনে করেন, এটি ছিল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ধ্বংসের সূচনা।
মেজর ডালিমের কর্মকাণ্ডের পেছনের উদ্দেশ্য এবং নৈতিকতাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি জাতির বৃহত্তর স্বার্থের জন্য কাজ করেছেন ।
১৫ আগস্টের ঘটনাগুলো বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনের যুগের সূচনা করে। এই অভ্যুত্থান শুধুমাত্র ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, বরং একটি জাতির ইতিহাসের ধারাকে নতুন রূপ দেয়। এ সময় রাষ্ট্র পরিচালনায় আইন ও শাসনব্যবস্থা বাংলাদেশে শান্ত পরিবেশ তৈরি করে।
শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে সমস্যার শেষ ছিলনা, তার নেতৃত্ব বাংলাদেশ ভারতের করলগত করার হাতিয়ার ছিলো। দুরদর্শী দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সদস্যরা বিষয়টি বুঝতে পেরে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।
বিপ্লব এবং এর আইনি গ্রহণযোগ্যতা হলো আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, যুদ্ধক্ষেত্রের হত্যাকাণ্ড বৈধ।
বিপ্লবীরা যদি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করেন, তবে তা ন্যায্যতার প্রশ্নে উঠে আসে। ১৫ আগস্টের ঘটনা “বিপ্লবের নীতি” এবং “ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ” তত্ত্ব ছিল তাই এটি গ্রহণযোগ্য।
১৫ আগস্টের ঘটনার পরে অনেক সামরিক কর্মকর্তা দেশ ছেড়ে চলে যান। মেজর ডালিম তাদের মধ্যে একজন। তিনি কি আবার দেশে ফিরবেন? তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ থাকলেও সমর্থকরা মনে করেন, তাকে দেশে ফেরানো উচিত। তারা মনে করেন, নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে ১৫ আগস্টের ঘটনাকে একটি বিপ্লবী অভ্যুত্থানের মর্যাদা দেয়া উচিত।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর ঘটনাগুলো আমাদের জাতির ইতিহাসের একটি উজ্বল এবং দৃষ্টান্তমূলক অধ্যায়। এটি একই সাথে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, এবং সামরিক শাসনের সুফল। মেজর ডালিম ও তার মতো অনেকের সৎসাহসী উদ্যোগের উনুসরণে ১৯৯০এ এরশাদের পতন এবং ২০২৪ এ স্বৈরাচারী হাসিনার পতন নিশ্চিত হয়েছে — এই দিনটিকে বিকৃত করতে চেয়েছে তারা, কিন্তু সত্য ঘটনা ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।
এই ঘটনাগুলোর সঠিক ইতিহাসের নিরপেক্ষ পর্যালোচনা করে আমরা সত্যিকারের স্বাধীনতার মর্ম উপলব্ধি করতে পারব। বিপ্লবের স্বপ্ন ও স্বাধীনতার স্বাদ আমাদের অতীত এবং ভবিষ্যতে লুকিয়ে আছে।
শেয়ার করুন
- Click to share on Facebook (Opens in new window) Facebook
- Click to print (Opens in new window) Print
- Click to share on WhatsApp (Opens in new window) WhatsApp
- Click to email a link to a friend (Opens in new window) Email
- Click to share on LinkedIn (Opens in new window) LinkedIn
- Click to share on X (Opens in new window) X
- Click to share on X (Opens in new window) X